সমাজসংস্কার, শিক্ষাবিদ,রাজনীতিবিদ ও উপমহাদেশের প্রথম রেংলার ছিলেন
আনন্দমোহন_বসু। তিনি তৎকালীন ভারতবর্ষের অবিভক্ত বাংলার ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহাকুমার ইটনা থানার (বর্তমান বাংলাদেশে কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলায়) ১৮৪৭ সালে ২৩ শে সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন।
পিতা পদ্মলোচন বসু বাস্তববাদী, সুপরিচিত এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। ১৮৬২ সালে, ১৫ বছর বয়সে, আনন্দ মোহন বসু পিতৃহারা হন;তখন তার পিতার বয়স ছিল মাত্র ৪০ বছর।পিতার মৃত্যুর পর সমস্ত ভূসম্পত্তি দেখভালের দায়িত্ব অর্পিত হয় তার মা উমাকিশোরী দেবীর উপর। অত্যন্ত বুদ্ধিমতী ও কর্মঠ নারী ছিলেন। সারা জীবন আনন্দ মোহন বসু তার মাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতেন।
আনন্দ মোহন বসুরা তিন ভাই ছিলেন। তাদের কোনো বোন ছিল না।বড় ভাই হরমোহন বসু ও ছোট ভাই মোহমী মোহন বসু। বাবার কর্মস্থল ও বসবাসের সুবিধার্থে ময়মনসিংহ শহরে নির্মিত বাড়িতে বসবাস করতেন। পরবর্তী সময়ে নিজ জেলায় শিক্ষা বিস্তারের জন্য তা দান করেছিলেন।
তখন এটি ‘ময়মনসিংহ ইনস্টিটিউশন ‘হিসেবে পরিচিত ছিল। বর্তমান নাম,সিটি কলেজিয়েট স্কুল,ময়মনসিংহ’।
আনন্দমোহন বসুর শিক্ষাজীবন শুরু হয় ময়মনসিংহের ‘হার্ডিঞ্জ বার্নাকুলার স্কুল’এ। হার্ডিঞ্জ স্কুল থেকে পাশ করার পর ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন। জিলা স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করায়,তাকে তৃতীয় গ্রেডে ( বর্তমান অষ্টম শ্রেণিতে) প্রমোশন দেয়া হয়।
১৮৬২ সালে ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে এন্ট্রাস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধা তালিকায় নবম স্থান অধিকার করেছিলেন। ময়মনসিংহে বসবাস করা ১৫ বছরের একটি বালকের জন্য এটি অনেক বড় অর্জন হলেও, আনন্দ মোহন বসুর পরবর্তী শিক্ষাজীবনের সাফল্যের তুলনায় এটি ছিল নগণ্য।
এন্ট্রাস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর তিনি ১৮৬৩ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৮৬৪ সালে এফএ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং ১৮৬৭ সালে বি এ পরীক্ষাতেও প্রথম হন।
অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও বিস্ময়কর প্রতিভার জন্য অন্যান্য ছাত্রদের মাঝে হয়ে ওঠেন সুপরিচিত ও শ্রদ্ধারপাত্র।
আনন্দ মোহন বসুর গণিত বিষয়ে দক্ষতা তার অনেক শিক্ষকের চেয়েও বেশি ছিল। এম এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সাথে সাথেই তাকে প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রকৌশল বিভাগে গণিতের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তিনিই প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রথম ভারতীয় সর্বকনিষ্ঠ(২২) শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।
বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর এবং এম এ পরীক্ষার পূর্বে এই মধ্যবর্তী সময়ে, আনন্দমোহন বসু, ভগবান বসুর জেষ্ঠ কন্যা এবং আচার্য বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর বোন, স্বর্ণপ্রবা দেবীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ভগবান বসু ছিলেন ময়মনসিংহ জেলায় স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং আনন্দমোহনেরও শিক্ষক।
প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে আনন্দমোহন বসু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১০ হাজার টাকা বৃত্তি লাভ করেছিলেন। পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষার্থে আনন্দমোহন বসু বিলেতে গমন করেন এবং ক্যামব্রিজের ‘ক্রাইস্ট কলেজ’ এ ভর্তি হন।
নানা জটিলতা ও বিপত্তির মাঝেও আনন্দমোহন বসু ক্যামব্রিজে গণিতের একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে বেশ পরিচিতি লাভ করেন এবং বার্ষিক পরীক্ষায় নবম স্থান অধিকার করেন। পুরো ভারতবর্ষের মধ্যে তিনিই প্রথম রেংলার হয়েছিলেন।
আনন্দ মোহন বসু গণিতের রেংলার হওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার পাশাপাশি, ভবিষ্যতে সাধারণ মানুষের কাজে নিয়োজিত হওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করেছিলেন। তিনি ইউনিভার্সিটি ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন।
ইংল্যান্ডের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্তি করে ১৮৭৪ সালের ১২ই অক্টোবর ভারতবর্ষের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন।
ভারতের তৎকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয়ে আনন্দ মোহন বসুর মধ্যে বেশ উদ্বিগ্নতা ছিল। তিনি সবসময় এই আশা ব্যক্ত করতেন যে, তার মাতৃভূমির সকল দুর্দশা অবশ্যই একদিন কেটে যাবে।
১৮৭৪ সালের ৩ নভেম্বর আনন্দমোহন বসু কলকাতায় ফিরে আসেন।এর কয়েকদিন পর কলকাতা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন।
আনন্দ মোহন বসু বিলেত থেকে ফিরে যখন কলকাতায় স্থায়ী হন, তখন এর পিছনে পেশাগত কারণ মুখ্য ছিল না। তিনি আইন পেশা বেছে নিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু তার কর্মোদ্দীপনা সবটাই ছিল দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও শিক্ষা ক্ষেত্রে উন্নয়ন সাধনের জন্য।
আনন্দ মোহন বসুর দীর্ঘ জনসেবামূলক কাজ প্রথম জনসম্মুখে আসে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ১৪তম অধিবেশনের সভাপতি হিসেবে বক্তব্য প্রদানের পর। জন্মভূমির প্রতি ভালোবাসাই ছিল আনন্দ মোহন বসুর জনসেবার মূল প্রেরণা। এই তাড়না থেকে কোন পুরস্কারের আশা না করে তিনি অক্লান্তভাবে দেশের জন্য নিরন্তর কাজ করে গেছেন।
আনন্দ মোহন বসু ‘ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন’ বা ‘ভারত সভা’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ভারতীয়দের সার্বিক কল্যাণ, স্বার্থরক্ষা ও জাতীয় চেতনা বোধের জাগরণই এ সংগঠনের মূল লক্ষ্য ছিল।’ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ ধীরে ধীরে রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজেদের গুরুত্ব ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করতে থাকে।
১৮৭৬ সালে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার্থীদের বয়সসীমা ২১ বছর হতে কমিয়ে ১৯ বছর করে যেই বিধি প্রবর্তন করে, এর তীব্র প্রতিবাদ জানায় ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’। কারণ সবাই বুঝতে পেরেছিলেন যে, ১৯ বছর বয়সে কোনো ভারতীয় ছাত্রের পক্ষে সুদূর বিলেতে গিয়ে নতুন পরিবেশে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া দুরূহ হয়ে পড়বে। ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ এ বিধির প্রতিবাদ করে এবং সিভিল সার্ভিসকে জাতীয়করণের দাবি জানিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলেন।
১৭৭৮ সালের ‘বার্নাকুলার প্রেস’ এর মত নিপীড়নমূলক আইনের বিরুদ্ধে ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’ জোরালো প্রতিবাদ শুরু করে।
আনন্দ মোহন বসু ১৮৮৫ সালে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন এই ভেবে যে সংগঠনের বৃহত্তর স্বার্থে এবং নতুন মুখ যুক্ত করার উদ্দেশ্যে। সে বছরেই ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ এর প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে আনন্দ মোহন বসু এর অন্যতম সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৮৯৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পশ্চিমবঙ্গে প্রতিনিধি সম্মেলনে আনন্দমোহন বসু সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি কখনো সস্তা জনপ্রিয়তাকে পছন্দ করেননি
আনন্দ মোহন বসু কেবল একজন মঞ্চের বক্তা কিংবা শুধুমাত্র তথাকথিত আন্দোলনকারী ছিলেন না। তার আচার-আচরণ ও কর্মকান্ড ছিল সুসম্পূর্ণ এবং সুদূর প্রসারী একজন রাষ্ট্রনায়কের মত। দেশের জন্য তার সকল কাজই ছিল খুবই যুক্তিভিত্তিক, বিজ্ঞতাপূর্ণ ও দূরদর্শিতামূলক। তার আন্তরিক ও গভীর রাজনৈতিক অন্তরদৃষ্টি এবং শিক্ষাক্ষেত্রে গভীর আগ্রহ সুনিপুণভাবে গোছানো ছিল।
তিনি অন্যান্য ক্ষেত্রের পাশাপাশি সাধ্য অনুযায়ী সারাজীবন শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য মেধা ও শ্রম বিনিয়োগ করেছেন। তিনি অনুভব করেছিলেন যে ভারতের অগ্রযাত্রার কাজ যৌক্তিকভাবে শিক্ষাক্ষেত্র থেকেই শুরু করতে হবে।সেই লক্ষ্যে ভারতবর্ষে শিক্ষা বিস্তারের জন্য বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
স্পষ্টভাবেই বলেছিলেন, ছাত্র যুব সমাজের হাতেই দেশের ভবিষ্যৎ। আনন্দ মোহন বসু ভারতবর্ষের সর্বপ্রথম ছাত্র সংগঠন ‘স্টুডেন্টস্ এসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা করেন।যেটি শিক্ষা বিস্তারে অনেকটা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পূরক হিসেবে কাজ করেছিলো।
১৮৭৭ সালে আনন্দ মোহন বসু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের ফেলো নির্বাচিত হন। এর পরের বছর অর্থাৎ ১৮৭৮ সালে তিনি সিন্ডিকেট সদস্য হন। ১৮৯৫ সালের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে প্রথম প্রতিনিধি হিসেবে ‘বেঙ্গল আইন’ পরিষদের সদস্য নির্বাচিত করেছিলো।
ঠিক আছে আনন্দ মোহন বসুর কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ ভারত সরকার ১৮৮২ সালে তাকে শিক্ষা কমিশনের (হান্টার কমিশন) সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেন।
১৮৭৯ সালে কলকাতা সিটি কলেজ প্রতিষ্ঠার পেছনে আনন্দমোহন বসুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।আনন্দ মোহন বসুর নিজ জেলা ময়মনসিংহে সিটি কলেজের একটি শাখা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং আশা প্রকাশ করেছিলেন যে, ভবিষ্যতে এই কলেজের আরও শাখা প্রতিষ্ঠিত হবে। একটি শিক্ষা মিশন পরিচালনা করার অভিপ্রায়ে সংঘ গড়ে তুলেছিলেন, যাদের হাতে সিটি কলেজের বিভিন্ন শাখা গড়ে তোলার দায়িত্ব দিয়েছিলেন।কিন্তু তার এ পরিকল্পনা সফল হয়নি। সিটি কলেজের শাখাটি বর্তমানে কলকাতা নগরীর রাজা রামমোহন সারণীতে আনন্দমোহন কলেজ নামে প্রতিষ্ঠিত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন স্নাতক পর্যায়ের একটি কলেজ।
১৮৯৬ সালে ভারত সরকার শিক্ষা ব্যবস্থাকে সংস্কারের পরিকল্পনা উত্থাপন করলে আনন্দমোহন বসু খুব জোরের সাথে তার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কারণ তিনি মনে করেছিলেন এতে সত্যিকার ভাবে শিক্ষা বিস্তারে কাজ করবে না। জাতীয় কংগ্রেসের দ্বাদশ অধিবেশনে তিনি একটি প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য মনোনীত হলেন। অধিবেশনের সময় সরকারের শিক্ষা-সংস্কার বাতিলের দাবিতে একটি শক্তিশালী ও কার্যকর সমালোচনা উপস্থাপন করেছিলেন।
আনন্দমোহন বসু নারী শিক্ষার ব্যাপারেও সমভাবে আগ্রহী ছিলেন। বাংলার নারীদের উচ্চ শিক্ষার বিষয়টি তার কাজের উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল। বাংলা প্রদেশে নারীদের শিক্ষা গ্রহণের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির জন্য বঙ্গমহিলা বিদ্যালয় ও বেথুন স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
১৮৭৯ সালে বেথুন স্কুল থেকে প্রথম ভারতীয় বাঙালি নারী হিসেবে কাদম্বিনী বসু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অধীনে অনুষ্ঠিত এন্ট্রাস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। আনন্দ মোহন বসু ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাদেরও একজন ছিলেন। ১৮৯৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শান্তি দিবস উপলক্ষে ‘উইশবেক পিস অ্যাসোসিয়েশন’ থেকে আয়োজিত এক বিশাল জনসভায় বক্তৃতা দেন। তিনি সেখানে বলেছিলেন ইংল্যান্ডের নীতি হওয়া উচিত স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও মানবতার ভিত্তিতে।
১৯০৫ সালে ঐতিহাসিক বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন আনন্দমোহন বসু। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি দেশবাসীকে ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করে দেশীয় পণ্য ব্যবহারের পাশাপাশি পণ্য উৎপাদন বৃদ্ধির আহ্বান করেন।
১৯০৬ সালের ২০ আগস্ট, বাংলা ১৩১৩ সনের ৪ ভাদ্র সোমবার,সূর্যাস্তের সাথে সাথে কলিকাতাস্থ সার্কুলার রোডের আচার্য বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর বাড়িতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন,ক্ষণজন্মা, মহাপ্রাণ আনন্দমোহন বসু।
১৯০৬ সালে আনন্দ মোহন বসুর মৃত্যুর পর ময়মনসিংহ সিটি কলেজ নানা সংকটের সম্মুখীন হয়। প্রথমত, সিটি কলেজ কাউন্সিল অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে ময়মনসিংহ সিটি কলেজকে কলকাতা সিটি কলেজ থেকে বিযুক্তকরণের জন্য কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকট দাবি পেশ করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৮ সালের ৩১ শে মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কলিকাতা সিটি কলেজ থেকে ময়মনসিংহ সিটি কলেজের সংযুক্তি সম্পূর্ণ রূপে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
তখন কলেজের প্রিন্সিপাল বৈকুন্ঠ নাথ চক্রবর্তী কলেজের পুনর্গঠন এর উদ্যোগ নেন এবং ময়মনসিংহের তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি.জে.আর ব্ল্যাকউডের শরণাপন্ন হন। মি.জে. আর ব্ল্যাকউড স্থানীয় শিক্ষাবিদ ও উদ্যমী ব্যক্তিদের নিয়ে একটি নতুন কমিটি গঠন করে ‘ময়মনসিংহ কলেজ ‘ নামে কলেজটিকে পুনরুজ্জীবিত করেন।
এই কমিটি কলেজের পরিচালনা ও যাবতীয় খরচের দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং কলেজের জন্য তহবিল ও নতুন জায়গা সংগ্রহের জোরালো প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। ভারত সরকারের গ্রান্ট-ইন-এইড এর আওয়াত অর্থ সাহায্য প্রার্থীর জন্য বিভাগীয় কমিশনারের সাথে সাক্ষাৎ করেন কমিটির সদস্যগণ।
বিভাগীয় কমিশনার কলেজে নতুন ভবন নির্মাণের জন্য ৫৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেন। কলেজের সার্বিক উন্নতির জন্য স্থানীয় কয়েকজন জমিদার ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিগতভাবে ১ লক্ষ ১৮ হাজার ৩৯৫ টাকা তৎকালীন অনুদান প্রদান করেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের মধ্যে ছিলেন মহারাজা শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী (মুক্তাগাছা), যোগেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরী (রামগোপালপুর), রাণী দিনমণি চৌধুরানী (সন্তোষ), বাবু হেমচন্দ্র চৌধুরী (আম্বারিয়া),রাজা জগৎ কিশোর রায়চৌধুরী (গৌরীপুর), আবু প্রমথনাথ রায় চৌধুরী আসছে (সন্তোষ), রাণী হেমন্ত কুমারী দেবী (পুটিয়া), বামা সুন্দরী দেবী (ভবানীপুর) প্রমুখ।
আনন্দ মোহন কলেজ প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন ময়মনসিংহ জেলার প্রথম মুসলিম গ্র্যাজুয়েট আইনজীবী ও আনন্দ মোহন বসুর কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের সহপাঠী বন্ধু, ময়মনসিংহ আঞ্জুমান ইসলামিয়া এর সভাপতি ও বিশিষ্ট শিক্ষা অনুরাগী মৌলভী হামিদ উদ্দিন আহমদ।
কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য যখন পর্যাপ্ত পরিমাণে জমি পাওয়া যাচ্ছিল না কলেজের জন্য কাঁচিরঝুলিতে ২৬ বিঘা জমি দিয়েছিলেন এই শর্তে যে কলেজটির নামকরণ করতে হবে বন্ধু আনন্দ মোহন বসুর নামে। পল্লবী হামিদ উদ্দিন ছাড়াও তার জমির পার্শ্ববর্তী আরো কয়েক বিঘা জায়গা স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ কলেজের জন্য দিয়েছিলেন। সরকারি বেসরকারি নানা উৎস থেকে সংগৃহীত অর্থ এবং জমি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কলেজটির বর্তমান স্থানে স্থানান্তরের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। নতুন ভবন নির্মাণ সহ প্রয়োজনে অবকাঠামো তৈরি করে ১৯০৮ সালের শেষের দিকে ময়মনসিংহ কলেজের নাম পরিবর্তন করে মৌলভী হামিদ উদ্দিন আহমেদের প্রস্তাবমত কলেজের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা আনন্দ মোহন বসুর নাম অনুসারে ‘আনন্দমোহন কলেজ’ রাখা হয় এবং শিক্ষা কার্যক্রম পুনরায় চালু করা হয়।

আনন্দ মোহন কলেজ
কয়েক বছরের মধ্যেই এটি প্রথম শ্রেণীর কলেজে উন্নীত হয়। ফলে, ১৯১৪ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ‘আনন্দমোহন কলেজ’ কে প্রথম গ্রেডের কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। কাল পরিক্রমায় আজও স্বমহিমায় বাংলাদেশের একটি অন্যতম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘আনন্দমোহন কলেজ’ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে।জানা যায়, ময়মনসিংহ নারী শিক্ষার আদি প্রতিষ্ঠান বিদ্যাময়ী বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় আনন্দমোহন বসু সক্রিয় সহযোগিতা করেছিলেন।